রতন সূত্র

(১) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
সব্বে ভুতা সুমনা ভবন'
অথোপি সক্কচ্চ সুনন' ভাসিতং।

(২) তস্মাহি ভুতা নিসামেথ সব্বে
মেত্তং করোথ মানুসিযা পজায,
দিবা চ রত্তো চ হরন্তি যে বলিং

তস্মাহি নে রক্‌খথ অপ্পমত্তা।

(৩) যং কিঞ্চি বিত্তং ইধ বা হুরং বা
সগ্‌গেসু বা যং রতনং পনীতং,
ননো সমং অত্থি তথাগতেন।
ইদম্পি বুদ্ধে রতনং পনীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(৪) খযং বিরাগং অমতং পণীতং
যদজ্ঝগা সক্যমুনী সমাহিতো,
ন তেন ধম্মেন সমত্থি কিঞ্চি
ইদম্পি ধম্মে রতনং পণীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(৫) যং বুদ্ধসেট্‌ঠো পরিবন্নযী সুচিং
সমাধিমানন্তরিকঞ্‌ঞামাহু,
সমাধিনা তেন সমো ন বিজ্জতি।

ইদম্পি ধম্মে রতনং পণীতং,

(৬) যে পুগ্গল অট্‌ঠসতং পসত্থা
চত্তারি এতানি যুগানি হোন্তি,
তে দক্‌খিনেয্যা সুগতস্স সাবকা
এতেসু দিন্নানি মহপ্‌ফলানি
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(৭) যে সুপ্পযুত্তা মনসা দলহেন
নিক্কামিনো গোতম সাসনম্‌হি
তে পতিপত্তা অমতং বিগয্‌হ
লদ্ধা মুধা নিব্বুতিং ভূঞ্জমানা।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(৮) যথিন্দখীলো পঠবিং সিতো সিযা
চতুব্‌িভ বাতেভি অসম্পকম্পিযো,
তথুপমং সপ্পুরিসং বদামি
যো অরিযসচ্চানি অবেচ্চ পস্সতি
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(৯) যে অরিযসচ্চানি বিভাবযন্তি
গম্ভীর পঞ্‌ঞেন সুদেসিতানি,
কিঞ্চাপি তে হোন্তি ভুসপ্পমত্তা
ন তে ভবং অট্‌ঠমং আদিযন্তি।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(১০) সহাবস্স দস্সন সম্পদায
তযস্‌সু ধম্মা জহিতা ভবিন্ত,
সক্কাযদিট্‌ঠি বিচিকিচ্ছি তঞ্চ
সীলব্বতং বা’পি যদত্থি কিঞ্চি।
চতুহ’ পাযেহি চ বিপ্পমুত্তো
ছ চাভিট্‌ঠানানি অভব্বো কাতুং;
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(১১) কিঞ্চাপি সো কম্মং করোতি পাপকং
কাযেন বাচা উদ চেতসা বা,
অভব্বো সো তস্স পটিচ্ছদায
অভব্বতা দিট্‌ঠপাদস্স বুত্তা।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(১২) বনপ্পগুম্বে যথা ফুস্‌সিতগ্গে
গিম্‌হান মাসে পঠমস্মিং গিম্‌হে,
তথূপমং ধম্মবরং অদেসযী
নিব্বানগামিং পরমং হিতায।
ইদম্পি বুদ্ধে রতনং পণীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(১৩) বরো বরঞ্‌ঞু বরদো বরাহরো,
অনুত্তরো ধম্মবরং অদেসযী,
ইদম্পি বুদ্ধে রতনং পণীতং

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(১৪) খীণং পুরাণং নবং নত্থি সম্ভবং
বিরত্তচিত্তা আযাতিকে ভবস্মিং,
তেন খীনা বীজা অবিরূল্‌হিচ্ছন্দা
নিব্বন্তি ধীরা যথা’যং পদীপা।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,

এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।

(১৫) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
তথাগতং দেবমনুস্স- পুজিতং

বুদ্ধ নমস্‌সাম সুবত্থি হোতু।

(১৬) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
তথাগতং দেবমনুস্স-পুজিতং

বুদ্ধং নমস্সম সুবত্থি হোতু।

(১৭) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
তথাগতং দেবমনুস্স-পুজিতং

সঙ্ঘং নমস্সম সুবত্থি হোতু।


অনুবাদঃ-

 (১) ভূমিবাসী ও আকাশবাসী যে সকল প্রাণী এখানে সমাগত হইয়াছ, তোমরা সকলেই সন্তুষ্ট হও এবং আমার দেশিত বাক্য মনোযোগের সহিত শ্রবণ কর।
 (২)  (জগতে বুদ্ধবাক্য দুর্লভ) সেই হেতু তোমরা সকলে আমার উপদেশ মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর; মনুষ্যগণের প্রতি মৈত্রীচিত্ত পোষণ করিয়া তাহাদের হিত-সুখ কামনা কর; তাহারা দিবা-রাত্র তোমাদের উদ্দেশ্যে পুন্যদান করিয়া পূজা করে। এই কারণে তোমরা অপ্রমত্ত হইয়া তাহাদিগকে রক্ষা কর।
(৩) ইহলোক-পরলোকে অথবা স্বর্গ-ব্রহ্মাদিলোকে যাহা কিছু মূল্যবান মনি-রত্নাদি রত্ন আছে, তাহা তথাগত বুদ্ধের সমান নহে। সেই সকল রত্ন হইতে বুদ্ধরত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(৪) সমাধিস্থ শাক্যমুনি বুদ্ধ যেই লোভ-দ্বেষ-মোহ ক্ষয় বিরাগ ও অনুপম নির্বাণামৃত পান করিয়াছেন, সেই নির্বাণ ধর্মের সমান কিছুই নাই। ত্রিলোকের সমস্ত মূল্যবান ধন বা রত্ন হইতে এই ধর্ম রত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের প্রভাবে স্বস্তি বা মঙ্গল হউক।
(৫)  ত্রিলোক শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ যেই শুচি (রাগ-দ্বেষাদি ময়লাহীন পবিত্র) লোকোত্তর মার্গ-সমাধির (মার্গচিত্তের) প্রশংসা করিয়াছেন এবং যেই মার্গ-চিত্ত-উৎপত্তির পরক্ষণেই বিনা অন্তরায়ে স্বাভাবিক নিয়মেই উহার ফল-চিত্ত উৎপন্ন হইয়া থাকে, এইরূপ পবিত্র আর্য্যমার্গ-সমাধির (মার্গ-চিত্তের) সমান অন্য কোনও সমাধি নাই অর্থাৎ আর্য্যমার্গ-জ্ঞান সদৃশ অন্য কোন জ্ঞান নাই। জাগতিক্‌ সমস্ত ধন বা রত্ন হইতে এই ধর্ম রত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের স্বস্তি বা শুভ হোক।
(৬) যেই অষ্টবিধ আর্য্যপুদ্গলকে বুদ্ধাদি সৎপুরুষেরা প্রসংশা করিয়াছেন, যাঁহারা মার্গস'-ফলস্থ ভেদে চারিযুগ্ম ; যেই সুগত বুদ্ধের শ্রাবক বা শিষ্য দক্ষিণার উপযুক্ত পাত্র। সেই পুণ্যক্ষেত্র সংঘরত্নে দান করিলে মহাফল (মহৎপুণ্য) লাভ হয়। ইহা সংঘরত্নের শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা আমাদের শুভ বা কল্যাণ হউক।
(৭)  বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজিত হইয়া যাঁহারা শীলে সুপ্রতিষ্ঠিত সমাধিতে দৃঢ় (নিশ্চল) এবং বিদর্শন-ভাবনায় রাগ-দ্বেষ-মোহাদি ক্লেশমুক্ত হইয়াছেন, অথবা যাঁহারা শীল-সমাধি-বিদর্শনরূপ সাধন-পথে সাধন করিয়া অমৃতপথ (নির্বাণ) সাক্ষাৎকার করিয়াছেন। তাঁহারা এখন বিনামূল্যে লব্ধ নির্বাণ সুখ উপভোগ করিতেছেন অর্থাৎ তাঁহারা (অর্হৎগণ) ফল-সমাপত্তি (নির্বাণসমাধি) লাভ করিয়া নির্বাণ সুখ অনুভব করিতেছেন। ত্রিলোকের সমস্ত ধন বা রত্ন হইতে এই সংঘ রত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ বা মঙ্গল হউক।
(৮)  ভূমিতে দৃঢ়রূপে প্রোথিত ইন্দ্রখীল (নগরদ্বারস্থ স্তম্ভবিশেষ) যেমন প্রবল বায়ুতেও কম্পিত হয় না। যিনি চতুরার্য্য সত্য প্রজ্ঞা-চক্ষুতে স্পষ্টরূপে দর্শন করিতেছেন, তেমন সেই সৎপুরুষকেও আমি উক্ত ইন্দ্রখীলের সহিত তুলনা করি (অর্থাৎ তিনিও ইন্দ্রখীলের ন্যায় অচল অটল)। ত্রিলোকের সমস্ত ধন বা রত্ন হইতে এই সঙ্ঘরত্ন ও শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের কল্যাণ বা মঙ্গল হউক।
(৯) গভীর প্রাজ্ঞ বুদ্ধ কর্তৃক সুদেশিত চারি আর্য্যসত্যকে যাঁহারা জ্ঞানের গোচরীভূত করেন (জ্ঞান-চক্ষুতে দর্শন করেন) তাঁহারা প্রমাদবহুল হইলেও সংসারে আটবারের অধিক জন্মগ্রহণ করেন না- সপ্তম জন্মেই বিদর্শন ভাবনা করিয়া অরহত্ব-ফল লাভ করেন এবং আয়ুশেষে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। সঙ্ঘরত্নের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদক এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের স্বস্তি বা কল্যাণ হউক।
(১০) দর্শন সম্পদ অর্থাৎ স্রোতাপত্তি-মার্গ-জ্ঞান লাভের সঙ্গে সঙ্গেই সৎকায়দৃষ্টিসহ (অহং জ্ঞান) অপর যাহা কিছু মিথ্যাদৃষ্টি (৬২ প্রকার মিথ্যাদৃষ্টি), যাহা কিছু সংশয় (২৪ প্রকার সংশয়) এবং যাহা কিছু শীল-ব্রত (গোশীল গোব্রত, কুক্কুটশীল-কুক্কুটব্রতাদি নানাবিধ মিথ্যাশীল-মিথ্যাব্রত) এই তিন প্রকার মিথ্যা ধর্ম (সৎকায়-দৃষ্টি, সংশয় ও শীলব্রত) দূরীভূত হয়। তিনি চারি অপায় (নরক, তির্য্যক্‌যোনি, প্রেতলোক ও অসুরলোক) হইতে বিমুক্ত এবং ছয় প্রকার (মাতৃ-হত্যা, পিতৃহত্যা, অরহৎহত্যা, বুদ্ধের পাদ হইতে রক্তপাত, বুদ্ধের শরণ ব্যতীত অন্য শরণ গ্রহণ ও সঙ্ঘভেদ) মহাপাপ (গুরুতর পাপ) করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। পার্থিব ধন বা রত্ন হইতে এই সঙ্ঘ রত্নও শ্রেষ্ঠ এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(১১) তিনি (স্রোতাপন্ন পুরুষ) কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা পাপকর্মের অনুষ্ঠান করেন না; ভূলক্রমে ক্কচিৎ কোন ক্ষুদ্র পাপ করিলেও, তাহা গোপন করেন না। কারণ নির্বাণদর্শী স্রোতাপন্ন পুরুষের পক্ষে স্বভাবতঃ সামান্য পাপও গোপন করা সম্ভব নহে, ইহা সঙ্ঘ রত্নের শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের প্রভাবে তোমাদের শুভ হউক।
(১২) গ্রীষ্মঋতুর প্রথম মাসে (চৈত্রমাসে, বসন্তকালে) বন-গুল্মে বৃক্ষ-লতাদির শাখা-প্রশাখাসমূহ যেমন প্রস্ফুটিত নানা ফুলে শোভিত হয়, সেইরূপ স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, ইন্দ্রিয়, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি নানাবিধ হিতকর ধর্মবিষয়ে পরিশোভিত ও নির্বাণগামী মার্গদীপক ত্রিপিটক ধর্মদেব, মনুষ্যাদি জীবগণের হিতের জন্য ভগবান বুদ্ধ প্রচার করিয়াছেন। বুদ্ধরত্নের ইহাই শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(১৩) বর (শ্রেষ্ঠ), বরজ্ঞ, (নির্বাণজ্ঞ), বরদ (বিমুক্তি শান্তি দাতা) বরাহর (উত্তম প্রতিপদা বা মার্গ আহরণকারী), অনুত্তর (শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ) শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রচার করিয়াছেন অর্থাৎ বহুকল্প দুষ্কর সাধনা করিয়া ভগবান বুদ্ধ যেই নির্বাণ ধর্ম লাভ করিয়াছেন, তাহা তিনি সর্বলোকের হিতের জন্য জগতে প্রচার করিয়াছেন বিশেষার্থ এইঃ- শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ নির্বাণ ও নির্বাণলাভের শ্রেষ্ঠ প্রতিপদা (মার্গ) দেশনা করিয়াছেন- প্রচার করিয়াছেন সর্বজীবের মুক্তির জন্য। ইহা বুদ্ধরত্নের শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের মঙ্গল হউক।
(১৪) যাঁহারা অরহত্ব-ফল প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের পুরাতন কর্ম ক্ষীণ (বিনষ্ট) হইয়াছে, আর নূতন কর্মের উৎপত্তি নাই, পুনর্জন্মে তাঁহাদের আসক্তি নাই, তাঁহাদের পুনর্জন্মের কর্ম-বীজ বিনষ্ট এবং তৃষ্ণামূল উৎপাটিত হইয়াছে। সেই জ্ঞানবান অরহৎগণ এই প্রদীপের ন্যায় নির্বাপিত হইয়া থাকেন। সঙ্ঘরত্নের ইহাই শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(১৫)  তৎপর দেবরাজ ইন্দ্র বলিলেন;- ভূমিবাসী বা আকাশবাসী যেই সমস্ত ভূত বা সত্ত্বগণ এখানে সমাগত হইয়াছে, আস সকলে সম্মিলিত হইয়া দেব-মনুষ্যাদি সকলের পূজনীয় তথাগত বুদ্ধকে নমস্কার করি। এই নমস্কারের প্রভাবে সকলের শুভ হউক।
(১৬)  তৎপর দেবরাজ ইন্দ্র বলিলেন;- ভূমিবাসী বা আকাশবাসী যেই সমস্ত ভূত বা সত্ত্বগণ এখানে সমাগত হইয়াছে, আস সকলে সম্মিলিত হইয়া দেব-মনুষ্যাদি সকলের পূজনীয় ধর্মকে নমস্কার করি। এই নমস্কারের প্রভাবে সকলের শুভ হউক।
(১৭)  তৎপর দেবরাজ ইন্দ্র বলিলেন;- ভূমিবাসী বা আকাশবাসী যেই সমস্ত ভূত বা সত্ত্বগণ এখানে সমাগত হইয়াছে, আস সকলে সম্মিলিত হইয়া দেব-মনুষ্যাদি সকলের পূজনীয় সঙ্ঘকে নমস্কার করি। এই নমস্কারের প্রভাবে সকলের শুভ হউক।


শেষ গাথা তিনটি দেবরাজ ইন্দ্র বলিয়াছিলেন। এই সূত্র দেশনার ফলে বৈশালী নগরীতে সুবৃষ্টি হইয়াছিল। দুর্ভিক্ষভয়াদি যাবতীয় উপদ্রবের উপশম এবং নগরবাসী সকলের মঙ্গল হইয়াছিল।






রত্ন সূত্রের উৎপত্তি :

ভগবান বুদ্ধের জীবদ্দশায় বৈশালী অতিশয় সমৃদ্ধশালী নগর ছিল। কালের গতিকে সর্ববিধ উপভোগ্য পরিভোগ্য বিত্তসম্পদ সমৃদ্ধ বৈশালীতে অনাবৃষ্টি দেখা দিল। অনাবৃষ্টির দরুণ কৃষকগণের শস্যক্ষেত্র বিনষ্ট হইয়া ভীষণ দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া পতিত হইল। প্রথমে সহায় সম্বলহীন দরিদ্র মানুষেরা অনাহারে মৃত্যু বরণ করিতে লাগিল। তাহাদের মৃতদেহ নগরের বাহিরে ফেলিয়া দেওয়া হইত। কাজেই মৃতদেহের ভীষণ দুর্গন্ধ পাইয়া প্রেত-পিশাচাদি অমনুষ্যগণ নগরে আশ্রয় গ্রহণ করিল। কালক্রমে এত অধিক লোকের মৃত্যু হইতেছিল যে, মৃতদেহের সৎকার করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। পঁচা-দুর্গন্ধময় মৃতদেহ দেখিতে দেখিতে ভয়ানক ঘৃণার উদ্রেক হইল, ঘৃণার দ্বারা নগরে বিসুচিকা রোগের প্রাদুর্ভাব হইল। দুর্ভিক্ষ, রোগ ও অমুনষ্য উপদ্রব এই ত্রিবিধ ভয়ে সন্ত্রস্ত বৈশালীবাসী প্রজাসাধারণ রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাদের অসহ্য দুঃখ-কাহিনী বিবৃত করিতেছিলেন-
“মহারাজ, নগরে ত্রিবিধ ভয় উৎপন্ন হইয়াছে। ইতিপূর্বে রাজ-পরম্পরা সাত রাজার রাজত্ব কাল পর্য্যন্ত এরূপ দুর্দশা দেখা যায় নাই। আমাদের মনে হয়- ইহা আপনার অধার্মিকতার দ্বারাই ঘটিতেছে।” এতদশ্রবণে রাজা উদ্বিগ্ন চিত্তে মন্ত্রণাগৃহে সম্মিলিত হইয়া বলিলেন- “তোমরা আমার অধার্মিকতা সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখ।” তাহারা সকলে বিচার করিয়া রাজার কোনও দোষ দেখিতে পাইলেন না।
অতঃপর তাহারা রাজার কোন প্রকার দোষ দেখিতে না পাইয়া ভাবিতে লাগিলেন- “কি প্রকারে আমাদের এই দুর্দশার অবসান হইবে?” তথায় কেহ কেহ বলিতে লাগিল- পুরাণ কশ্যপ, মক্ষলি গোশাল প্রভৃতি আজীবক (সন্ন্যাসী) শাস্তাগণ আছেন। তাহাদের পদধূলি পড়িলেই বৈশালীর মঙ্গল হইবে। অপর কেহ কেহ বলিতে লাগিল- “জগতে বুদ্ধ উৎপন্ন হইয়াছেন। সেই ভগবান সমস্ত প্রাণীর হিতের জন্য ধর্মোপদেশ করিয়া থাকেন। তিনি মহাঋদ্ধিবান, মহাপ্রভাবশালী। তাঁহার পদার্পণেই আমাদের সমস্ত ভয় তিরোহিত হইয়া যাইবে।”
‘বুদ্ধ’ এই নাম শুনিয়া তাহারা সকলে আনন্দিত হইয়া বলিতে লাগিল- “ভগবান বুদ্ধ সম্প্রতি কোথায় অবস্থান করিতেছেন? আমরা যদি লোক প্রেরণ করি, তিনি আসিবেন কি?” এ প্রস্তাবে অপর কেহ কেহ বলিতে লাগিল- “বুদ্ধগণ লোকের প্রতি অনুগ্রহকারী, কেন আসিবেন না?” তিনি এখন রাজগৃহে আছেন, মহারাজ বিম্বিসার তাঁহার সেবা করেন। তিনি যদি আসিতে বাধা না দেন, তবে অবশ্যই আসিবেন। “তাহা হইলে রাজাকে জানাইয়া আনয়ন করিব।” এই ভাবিয়া তাহারা দুইজন লিচ্ছবিকুমারকে সৈন্যবাহিনীসহ প্রভূত উপঢৌকন দিয়া রাজা বিম্বিসারের নিকট পাঠাইলেন এবং বলিলেন “রাজা বিম্বিসারকে বলিয়া ভগবানকে লইয়া আস।” তাঁহারা রাজগৃহে যাইয়া, রাজা বিম্বিসারকে তাঁহাদের উপঢৌকন প্রদান পূর্বক মনোবাঞ্চা নিবেদন করিলেন। রাজা তাঁহাদের অনুরোধ রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়া কহিলেন- “ইহা তোমরাই বুঝিতে পার।”
তাঁহারা ভগবানের চরণে উপনীত হইয়া প্রার্থনা করিলেন- “ভন্তে, আমাদের নগরে ত্রিবিধ ভয় উৎপন্ন হইয়াছে, যদি করুনাধার ভগবান করুনা করিয়া একবার বৈশালীতে শুভপদার্পন করেন, আমাদের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইবে।”
তখন ভগবান সর্বজ্ঞতা প্রভাবে চিন্তা করিয়া দেখিতে পাইলেন- “আমি যদি বৈশালীতে ‘রত্নসূত্র’ দেশনা করি, তাহা হইলে ইহা কোটি শত সহস্র চক্রবালের রক্ষাদ- সদৃশ হইবে এবং চুরাশী হাজার প্রাণীর ধর্মজ্ঞান উৎপন্ন হইবে।” এই চিন্তা করিয়া ভগবান তাঁহাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন।
রাজা বিম্বিসার ভগবান নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছেন জানিয়া যথোচিত উৎসব এবং ধুমধামের সহিত আগু বাড়াইয়া দিলেন। আর বৈশালীবাসীর ও রাস্তা-ঘাট সুসজ্জিত করিয়া স্তসম্মানে ভগবান বুদ্ধকে আগু বাড়াইয়া লইলেন। ভগবান বৈশালীর সীমায় পৌঁছিলে লিচ্ছবিগণ রাজা বিম্বিসারের চেয়ে দ্বিগুণ পূজা করিলেন।
সেই সময় আকাশ হঠাৎ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল এবং বিদ্যুৎ চমকিয়া গড় গড় শব্দে মেঘ গর্জ্জন করিতে করিতে বারিবর্ষণ আরম্ভ করিল। মূষলধারে বারিবর্ষণের ফলে যেই জলপস্নাবন হইয়া ছিল, তাহা দ্বারা বৈশালীর দুর্গন্ধ মৃতদেহ ভাসিয়া গিয়া ভূভাগ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া গেল। ভগবান যখন বৈশালীতে উপনীত হইলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবপরিজন পরিবৃত হইয়া তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। মহাপ্রভাবশালী দেবতাগণের আবির্ভাবে প্রেত-পিশাচাদি অমনুষ্যদের অনেকে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

অতঃপর ভগবান বুদ্ধ, প্রিয় শিষ্য আনন্দ স্থবিরকে ডাকিয়া কহিলেন- “আনন্দ, এই ‘রত্নসূত্র’ শিক্ষা করিয়া ধর্মপূজার উপকরণ সমূহ গ্রহণ করাইয়া লিচ্ছবি কুমারগণসহ বৈশালী নগরে তিনটি প্রাকারের অন্তরে বিচরণ করিতে করিতে আবৃত্তি কর।” কোটিলক্ষ চক্রবালের দেবতাগণ সেই ‘রতন সূত্রের’ আদেশ পালনে বাধ্য হয়। তাহারই প্রভাবে বৈশালীর রোগভয়, অমনুষ্য ভয় ও দুর্ভিক্ষভয় শীঘ্রই অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। স্থবির আনন্দ ভগবানের আদেশে পরিত্রাণ পাঠ করিতে করিতে ভগবানের ব্যবহৃত পাত্রে জল লইয়া সমস্ত নগরে ছিটাইয়া ছিটাইয়া বিচরণ করিয়াছিলেন। এই জন্য ভূমিকায় বলা হইয়াছে “বেসালিযা পুরে তিসু পাকারন্তরেসু ...... আযস্মা আনন্দথোরো বিয কারুঞ্‌ঞচিত্তং উপট্‌ঠপেত্বা।”


রত্ন সূত্রের ভূমিকা:

ভগবান গৌতম বুদ্ধ সুমেধ তাপস জন্মে অমরাবতী নগরে ভগবান দীপঙ্কর বুদ্ধের পদতলে পতিত হইয়া বুদ্ধত্ব লাভের যে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, সেই প্রার্থনা হইতে আরম্ভ করিয়া তথাগতের দশ পারমিতা (দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, প্রজ্ঞা, বীর্য্য, ক্ষান্তি, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী ও উপেক্ষা), দশ উপপারমিতা (অধম ভাবে পূর্ণ দশ পারমিতা), দশ পরমার্থ পারমিতা (উক্ত দশপারমিতা উত্তমরূপে পূর্ণ হইলে পরমার্থ পারমিতা হয়), মোট ত্রিশটি পারমিতা; পঞ্চ মহাদান, জগতের হিতাচরণ; জ্ঞাতিগণের হিতাচরণ, বুদ্ধ হওয়ার জন্য সদাচরণ, এই তিন প্রকার আচরণ, শেষ জন্মে অর্থাৎ যে জন্মে বুদ্ধ হইয়াছিলেন সে জন্মে মায়ের গর্ভে প্রবেশ, জন্ম, সংসার ত্যাগ, কঠোর তপস্যা, বোধিবৃক্ষের মূলে মার-বিজয়, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ, ধর্মচক্রপ্রবর্তন ও নবলোকোত্তর ধর্ম প্রচার ইত্যাদি সকল প্রকার বুদ্ধগুণ স্মরণ করিয়া বৈশালী নগরের প্রাচীরত্রয়ের মধ্যে তিন প্রহর রাত্রি পরিত্রাণ পাঠকারী আয়ুষ্মান আনন্দ স্থবিরের মত করুনা পূর্ণ চিত্তে আমারা-

শত সহস্র কোটি চক্রবালবাসী দেবতাগণ যেই রত্নসূত্রের আদেশ প্রতিপালন করেন এবং সেই রত্নসূত্র পাঠে বৈশালী নগরীতে রোগ, অমনুষ্য ও দুর্ভিক্ষ এই তিন প্রকার ভয় শীঘ্রই দুরীভূত হইয়াছিল, সেই রত্নসূত্র (পরিত্রাণ) পাঠ করিতেছি।

No comments:

Post a Comment